একদল পাইলটিয়ান ও কিছু রুপকথা

1
১ জানুয়ারি ২০০৯... পৌষের কনকনে শীতের মধ্যেই শুরু হয়েছিল জীবনের একটি নতুন অধ্যায়। নতুন গল্প এবং স্থপিত হয়েছিলো একটি ভালোবাসার ভিত্তি. যদিও তখন বুঝতে পারি নি সাদা শার্ট আর নেভি ব্লু প্যান্টের এই সম্পর্কের গভীরতা যে এতো বেশি হবে!! যে ভালোবাসা  রক্তের সম্পর্ককেও ছাড়িয়ে যাবে সেটা তখন কল্পনাতেও আসে নি।  বরং পুরোনো বন্ধুদের হারানোর ব্যাথা কুঁকড়ে কুঁকড়ে খাচ্ছিলোসেই ভালোবাসা টা শুরু হয়েছিল ও একটি আজব কক্ষে, এমন আজব আকৃতির কক্ষ আপনি আর বাংলাদেশের কোন বিদ্যালয়ে খুঁজে পাবেন না.....

কোনো এক ঈদে একদল পাইলোটিয়ান

কয়েকদিন পর ভর্তি পরীক্ষা হলো। আমার রোল হলো ১!! যদিও আমি রিফাত আর হামজা সমান নাম্বার ই পেয়েছিলাম, লটারিতে আমার রোল হলো ১, রিফাতের ২, হামজার ৩!! আমরা তিনজন ক্লাস ক্যাপ্টেন!!! ক্লাশ ক্যাপ্টেন মানেই আলাদা একটা পাওয়ার, পোলাপানকে ভালোই অত্যাচার করেছি, এর জন্য সবার কাছে আমি মাফ চেয়ে নিচ্ছি। তখন আমাদের সবচেয়ে মজার ক্লাস ছিলো ২য় ক্লাস, ইংরেজি ১ম পত্রের ক্লাস, আহা!!  হাশিম স্যার!! আর সবচেয়ে আতংকের ক্লাস ছিলো লাষ্ট ক্লাস, মিজান স্যার। পুরোদিনের সব অনিয়মের বিচার ওই ক্লাসেই হতো। স্যারের মাইর ছিলো দুঃস্বপ্নের মতো বা তারচেয়েও বেশি কিছু ..

আমার বাসা থেকে স্কুল একটু দূরেই ছিলো, তাই আমার যাতায়াতের জন্য একটি রিকশা ঠিক করা ছিলো। সৈকতের বাসা আর আমার বাসা কাছাকাছিই ছিলো, তাই আমরা একসাথেই যাওয়া-আসা করতাম। সৈকত ছিলো একটু মোটা আর আমি ছিলাম একদম টিংটিঙে, তো একদিন স্কুল যাবার সময় হঠাৎ রিকশার টায়ার ফেটে গেলো..আমি সবসময় সৈকতকে বলতাম, "তুই রিকসায় উঠিস না, টায়ার ফেটে যাবে" কিন্তু সেদিন দেখা গেলো আমি যেই পাশে বসেছিলাম ঠিক সেই পাশের টায়ারই ফেটে গেছে, কপাল খারাপ থাকলে যা হয় আর কি..

সৈকত প্রথম প্রথম আমার সাথেই বসতো.. কিন্তু আসতে আসতে সে পিছনে বসা শুরু করলো..কারন গল্পের বইয়ের প্রতি তার মারাত্মক নেশা ছিলো এবং সে প্রায় ক্লাসেই বইয়ের ভিতরে গল্পের বই রেখে পড়তো। তার বাসা ছিলো ছোটোখাটো একটি লাইব্রেরী। এই গল্পের বই পড়তে গিয়ে ধরা পড়ে একদিন মিজান স্যারের হাতে উদুম কেলানি খেয়েছিলো। 

আমাদের বেঞ্চ গুলি একটু বড়ই ছিল, এক বেঞ্চে ৫ জন বসা যেত আমি ক্যাপ্টেন হবার কারণে আমাকে সামনেই বসতে হতো। আমার পাশে বসতো ফয়সাল, তারপর মনজু, তারপর হাবিব এবং শেষে হারুন..

ওহ!! আপনাদের তো আমাদের বিদ্যালয়ের বর্ণনাই দেওয়া হয় নি!!! আমাদের বিদ্যালয়ের নাম রায়পুর এল.এম পাইলট মডেল উচ্চ বিদ্যালয়। এটি আমাদের লক্ষ্মীপুর জেলার তথা পুরো বাংলাদেশের প্রাচীনতম শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে একটি। এটি প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ১০ বছর পূর্বে অর্থাৎ ১৯১১ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। রায়পুর উপজেলার মধ্যে আমাদের বিদ্যালয় সরকারি হওয়ার কথা থাকলেও পরবর্তীতে কিছু ষড়যন্ত্রের কারনে সরকারি হয় নি। কিন্তু রায়পুর উপজেলার একটি সোনালী প্রজন্ম আমাদের বিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন।
এখনকার প্রজন্মের প্রধান পছন্দ কার/বাইক হলেও আমাদের ক্রাশ ছিলো সাইকেল। তখনকার যাদের দূরে বাড়ি ছিলো প্রায় সবার সাইকেল থাকলেও আমার সাইকেল ছিলো না। আমি সাইকেল কিনার জন্য বায়না ধরলে আমার মা একটি রিকশা কিনে একজনকে দিয়ে দেন, তার কাজ ছিলো আমাকে এবং সৈকতকে বিদ্যালয়ে আনা-নেওয়া। যতদূর মনে পড়ে ষষ্ঠ শ্রেণিতে থাকাকালীন মনজুর একটি Ranger Max, পানুর একটি লাল সাইকেল এবং মিরাজের নীল বা অন্য কোনো কালারের সাইকেল ছিলো।পানু এবং মিরাজ নিয়মিত সাইকেল না আনলেও মনজু প্রতিদিন স্কুলে সাইকেল আনতো এবং আমি মনজুর পিছনে পিছনে একটু সাইকেল চালানোর জন্য ঘুরতাম। মনজুর তখন দাম বেড়ে যেতো, কোনদিন মনে চাইলে চালাতে দিতো, কিন্তু বেশিরভাগ সময়ই দিতো না। 

আমার বাবা ব্যাংকার হবার সুবাদে প্রায়ই টাটকা টাকা পেতাম, তো একদিন স্কুলে ৫ টাকার একটি টাটকা নোট নিয়ে গিয়েছিলাম, পরে সেটি কোনো একজনের কাছে ৬ টাকায় বিক্রি করে দি। ওইটা ছিলো জীবনের প্রথম লাভজনক বিজনেস, এরআগে অনেকবার বাড়ির উঠানে দোকান দিলেও দিনশেষে দেখা গিয়েছে কেউ পন্য কিনে টাকা দেয় নি, মানে ১০০০০% লস। আরো একবার মনজুর কাছ থেকে ৫ টাকা ধার নিয়েছিলাম, ওইসময় ৫ টাকাও অনেক টাকা ছিলো, অনেককিছু পাওয়া যেতো, তো যাই হোক ধার শোধ করার সময়ে মনজুকে ৩ টাকা দিয়ে বাকি ২ টাকা দিচ্ছিলাম না, খালি ঘুরাচ্ছিলাম। পরে একদিন মনজু বললো: “তুই কেয়ামতের দিনে এই ২ টাকা নিয়ে আমার পিছনে দৌড়াবি, আমি কিন্তু সেদিন তোকে মাফ করবো না!!"" এই কথা শুনে ওইদিনই ২ টাকা দিয়ে দিছিলাম। ২ টাকার জন্য নাকি বন্ধু বন্ধুকে এমন খোঁটা দেয়!!!!


Post a Comment

1Comments
Post a Comment