ব্রাজিল, এই নামটি শুনলে আপনার মনে সর্বপ্রথম কোন জিনিসটি আসে?? অবশ্যই ফুটবল, ব্রাজিলের নাম শুনলে ফুটবলের কথা মনে আসবে না, এমন লোক হয়ত খুঁজে পাওয়াই যাবে না। আর মনে আসবেই না কেন?? ব্রাজিলকে বলা হয় ফুটবলের তীর্থভূমি। বলা হয়ে থাকে ফুটবলের জন্ম ইংল্যান্ডে, এবং ফুটবলকে পরিপূর্ণতা দিয়েছে ব্রাজিল। ব্রাজিলিয়ানরা ফুটবলকে ধর্মের মতো মনে-প্রানে ধারন করে। ব্রাজিল অলি-গলি, বস্তি থেকে যুগে যুগে বিশ্বসেরা ফুটবলার উপহার দিয়েছে...
ব্রাজিল এবং ফুটবলকে এক সুতোয় গেঁথে বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরার কাজে সামনে থেকে যিনি নেতৃত্ব দিয়েছেন তিনি হচ্ছেন পেলে..যাঁকে Black Diamond বা কালো মানিক বলা হয়। ফুটবলের এমন কোনো অর্জন নেই যা তিনি পান নি। তাই তাঁকে বলা হয় ফুটবলের রাজা, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ , The Greatest Of All Time.
১৯৪০ সালের ২৩ অক্টোবর ব্রাজিলের ত্রেস কোরাচয় শহরের এক দম্পতি- দন্দিনহো এবং সেলেস্তে আরাসের ঘর আলো করে জন্ম নেন এক সন্তান। বাবা দন্দিনহোও একজন ফুটবলার ছিলেন, তিনি তাঁর সন্তানের নাম রাখেন "এদসোঁ আরাঁচ দু নাসিমেঁতু"। বিজ্ঞানি টমাস আলবা এডিসনের নামানুসারে পেলের এই নাম রাখা হয়েছিল। কিন্তু ওইযে বল্লাম, ব্রাজিলিয়ানরা ফুটবলকে ধর্মের মতো ধারন করে, ব্রাজিলের প্রতিটি শিশুর হাতেখড়ি হবার আগেই তারা ফুটবল নিয়ে অলিতে-গলিতে দাপিয়ে বেড়ায়। পেলেও তার ব্যাতিক্রম ছিলো না। তাঁর প্রিয় ফুটবলার ছিলেন স্থানীয় ক্লাব ভাস্কো দা গামার গোলরক্ষক বিলে। বিদ্যালয়ে ভর্তি হবার পরে তাঁকে তাঁর ডাকনাম জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বিলে বলতে গিয়ে ভুলক্রমে পেলে বলে ফেলেন। পরে দেখা যায় যে, পর্তুগিজ ভাষায় পেলে নামে কোনো শব্দ নেই, পেলে একটি হিব্রু ভাষার শব্দ যার অর্থ "অলৌকিক"
অন্য দশটি ব্রাজিলিয়ান শিশুর মতো পেলের শৈশবও কেটেছে দারিদ্র্যের সাথে লড়াই করে। ফুটবল কেনার টাকা ছিলো না তাই মোজার ভিতরে কাগজ ডুকিয়ে ফুটবল বানিয়ে খেলেছেন। পরিবারের হাল ধরতে কখনো চায়ের দোকানে কাজ করেছেন, কখনো করেছেন জুতা মোছার কাজ। কিন্তু তার প্রভাব ফুটবলে উপরে পড়তে দেন নি। তাঁর বাবা ছিলেন তাঁর প্রথম কোচ, বাবার সাথেই তাঁর ফুটবলের পথ চলা শুরু।
১৬ জুলাই, ১৯৫০, ব্রাজিল প্রথম বিশ্বকাপ জয়ের দ্বারপ্রান্তে। সেদিন ব্রাজিলের প্রথম বিশ্বজয়ের সাক্ষী হতে মারাকানায় ফাইনাল ম্যাচ দেখতে হাজির হয়েছিলেন ১ লক্ষ ৭৩ হাজার ৮৫০ জন, যা এখন পর্যন্ত সর্বোচ্চ। কিন্তু সেদিন ব্রাজিল উরুগুয়ের কাছে ২-১ গোলে হেরে যায় এবং ওই হারের কারনে স্টোডিয়ামেই ১৬ জন ব্রাজিলিয়ান আত্নহত্যা করেছিলেন। এটি ব্রাজিলের ইতিহাসে মারাকানা ট্রাজেডি নামে পরিচিত। সেদিন পেলের বাবা দন্দিনহো বাসায় বসে খুব কেঁদেছিলেন। বাবার কান্না দেখে ১০ বছর বয়সী পেলে বাবাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলেছিলেন "বাবা তুমি কেঁদো না, আমি ব্রাজিলকে বিশ্বকাপ জেতাবো"! পেলে তাঁর কথা রেখেছেন। পেলের হাত ধরেই প্রথম ব্রাজিল বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হয়। শুধু তাই নয় পেলেই ইতিহাসের একমাত্র খেলোয়াড়, যিনি তিনটি বিশ্বকাপ জিতেছেন।
পেলের অভিষেক ম্যাচটি ছিলো চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী আর্জেন্টিনার বিপক্ষে। ১৯৫৭ সালের ৭ জুলাই মারাকানায় অনুষ্ঠিত সেই ম্যাচটিতে ব্রাজিল হেরে গেলেও মাত্র ১৬ বছর ৯ মাস বয়সে প্রথম গোল করে আন্তর্জাতিক ফুটবলের সর্বকনিষ্ঠ গোলদাতা হিসেবে নাম লেখান পেলে। তারপর আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয় নি তাঁকে। এরপর ১৯৫৮ সালের বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালে গোল করে বিশ্বকাপে ইতিহাসে সর্বকনিষ্ঠ গোলদাতা হিসেবে রেকর্ডবইয়ে নাম লেখান তিনি। তখন তাঁর বয়স ছিলো মাত্র ১৭ বছর ২৩৯ দিন!! সেই বছরই ব্রাজিল প্রথম বিশ্বকাপ ঘরে তোলে।
পেলে তাঁর ক্যারিয়ারের ১৩৬৩ ম্যাচে ১২৮১টি গোল করেছেন। এর মধ্যে ব্রাজিলের জার্সি গায়ে ৯২ ম্যাচে ৭৭ গোল এবং ক্লাব পর্যায়ে সান্তোসের হয়ে ৬৩৮ ম্যাচে ৬১৯ গোল করেন। পেলেকে ব্রাজিল সরকার ব্রাজিলের জাতীয় সম্পদ হিসেবে ঘোষণা করে, এবং তাঁকে ইউরোপে না খেলার জন্য অনুরোধ করেন, তাই তিনি কখনো ইউরোপে খেলেন নি। ১৯৭০ সালে তিনি তৃতীয় বিশ্বকাপ জিতেন, যা ছিলো ব্রাজিলেরও তৃতীয় বিশ্বকাপ শিরোপা।
২০২২ সালের ২৯ ডিসেম্বর নি:সন্দেহে ফুটবলের ইতিহাসের একটি কালোদিন, কারন এইদিনে ফুটবলের রাজা পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে না ফেরার দেশে চলে যান। দীর্ঘদিন ক্যান্সারের সাথে লড়াই করে ৮২ বছর বয়সে হার মানেন কালো মানিক। মৃত্যুর পূর্বে ব্রাজিলের ষষ্ঠ শিরোপা দেখে যেতে চেয়েছিলেন কিন্তু সবার ভাগ্যে তো সবকিছু জোটে না, এটাই হয়তো পৃথিবীর নির্মম সত্য।
![]() |
| Pelé (1940 - 2022) |







king Pele
ReplyDelete